
এই বেতলা কেচকি সার্কিট আমার খুব প্রিয়, ঝাড়খন্ড, পুরুলিয়া, ছত্তিসগড়, ওডিশার উত্তর-পশ্চিম।
কেচকি বাংলোতে আছি, অনেকটাই অরণ্যের দিন রাত্রির মত পরিবেশ। আর এই পরিবেশ থাকবে না, কারণ সামনে নতুন হটেল করছে, পাগলের দল। যাইহোক কেচকি বাংলোর সামনে মাইলের পর মাইল আদিগন্ত বিস্তৃত চর। এটা না দেখলে শরৎ চন্দ্রের বিহারের আঁচ করা যায়না। কেচকির চর তিনটে নদীর কনফ্লুয়েন্সে তৈরি, দূরে ঔরঙ্গা উপত্যাকার পাথুরে পাহাড়, একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে ইন্টারলকিং সিস্টেমে। রাতে পাহাড়ের গা দিয়ে মালগাড়ি আর লোকাল ট্রেন চলে, ঝুকচুক-ঝুকচুক করতে করতে, এক পাহাড় থেকে আলোর সারি বয়ে যায় অন্য পাহাড়ে। মাল গাড়িতে অবশ্য আলো থাকে না, তবে মাল গাড়ি গেলে উপত্যাকাটা ঝম ঝম করে।
কেচকিতে যেদিন পৌঁছলাম সেদিন গিয়েই আমি আর মৌসুমি এই খড়খড়ে সৌন্দর্যে আবিষ্ট হয়ে বাংলোয় লাগেজ রেখে, এক দৌড়ে স্নানের নামে একটা নদীতে শুয়ে পড়েছি, দূরে ব্রিজ, সিমেন্টের কিন্তু ছোটো, দুদিকের দুটো জনা-তিরিশ ঘরের গ্রাম জুড়েছে। ব্রিজের ওপর থেকে উপত্যাকার সুন্দর ছবি দেখাযায়। দুপুরবেলা আমরা নদী খাতে শুয়ে শুয়ে গল্প করছি আর পরচর্চা করছি, গায়ের ওপর দিয়ে সোঁ-সোঁ করে নদী বয়ে যাচ্ছে, টলটলে জল, কেউ কথাও নেই, গরু চড়ছে তার ঘন্টার আওয়াজ, মাঝে মাঝে গ্রামের দিক থেকে মটরবাইকের শব্দ ভেসে আসছে, আমাদের মাথাদুটো খালি জলের ওপরে, হাতে ভর দিতে হয়েছে একটু। এদিকে খেয়াল করিনি খানিকক্ষনের মধ্যেই ব্রিজের ওপর লোক জমে গেছে, আর অস্পস্ট কলকাকলি শোনাযাচ্ছে। যেই মাথা ঘুরিয়েছি দেখি লকগুলো আমাদের দিকে দেখে হাত নেড়ে নেড়ে কিসব বলছে। অব্যবহিত, সে কি কান্ড, সম্ভবত ভেবেছে আমরা নদীতে ভেসে চরে আটকে গেছি! ওদেরও দোষ নেই, আমরা নড়াচড়াও করছিলাম না, তারপর আবার একটু নড়ে বসলাম।
তা, সকালে এইসব করে, বিকেল থেকে সন্ধ্যে নদীর চরে গড়াগড়ি খেয়ে, বাঁশি বাজিয়ে বাংলোয় দিরেছি, রাতে দারোয়ান বললো মাছ ধরতে যাবেন? পারবেন? নদীর খাঁড়ি বেশ শক্ত ব্যাপার। ঠিক হলো রাত্তির দুটোর সময় মাছ ধরতে যাবো। আমরা চারজন সঙ্গে দুজন জেলে আর দারোয়ান জি। রাতে ছাড়া পরিস্কার জলে ওরা মাছ পায় না, ওরা কেচকিতে ভোর অবধি হাঁটু জলে মাছ ধরে, তিনটে নদীতেই হাঁটু জল, বড়জোর কোমর অবধি, তারপর অন্য কোথায় গভীর জলে নৌকা করে মাছ ধরে, সকালে হাটে বিক্রি করে, দুপুরে বাড়ি ফিরে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে, রেস্ট নিয়ে রাতে খেয়ে আবার মাছ ধরা।
প্ল্যান অনুযায়ী রাত দুটোয় আমরা চললাম, অকল্পনীয় সুবিশাল বালুচরে কিছুক্ষনের মধ্যেই অন্ধকারে দিগ্বিদিক শূন্য হয়েগেল, বাংলোর আলোটাও হারিয়ে গেলো। প্রথমে তো জেলেদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না, ওরা হন্ হন্ করে হেঁটে এগিয়ে গেছে, দারোয়ান জি আমাদের নিয়ে পিছিয়ে পড়েছে, তারপর কিছুক্ষন মোবাইল ইত্যাদি জ্বালিয়ে ঝোপ ঝাড় পাহাড়, বড় ব্রিজ, ছোটো ব্রিজ যেটার কথা আগে লিখেছি, আরেকটা বড় রেল ব্রিজ ছিলো অনেক দূরে, দিনেরবেলাই দুরত্বের জন্য ঝাপসা লাগে সেটা, তা সেই ব্রিজ-পাহাড়ের অদ্ভুত অঙ্ক দিয়ে জেলেদের অবস্থান কষে আমরা তিনটের মধ্যে একটা নদীর গভীর এক খাঁড়িতে পৌঁছলাম। আমি জলে নাবলাম, দারোয়ান অন্যদের নাবাতে সাহস পায়নি। ওরা পাড়ে দাঁড়িয়েই পড়েযাবো পড়েযাবো করছিলো। আর শুভদা নিজ গুনে সেই ট্রিপে আবার তার হলমার্ক দেওয়া ব্রিটিশ আমলের কোয়ালিটি শু পড়ে এসেছে, নিজেও জুতো খুলবে না কারুকে খুলতেও দেবে না। খানিক্ষন বকাবকি করার পর আমি খাঁড়িতে নাবলাম, নেবে জলের মধ্যে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করার পর দেখলাম সেদিন জেলেরা খালি চ্যাং মাছ পাচ্ছে। এদিকে বেশি আওয়াজ হলে মুশকিল, মাছ পালাবে, তাই আবার কসরত করে পাড়ে উঠে এলাম। এদিকে দারোয়ান জি, জেলেরা সব নদীতে, ওদের ফিরতে দেরি হবে। দারোয়ান জি আমাদের ভাবগতিক দেখে একটা ফাঁকা দিক দেখিয়ে বললো "আপনারা এদিক দিয়ে সোজা হাঁটুন বাংলোয় পৌঁছে যাবেন"। আমরা হাঁটছি, দিকের কোনো ধারণা নেই, সবই কম আলোয় ঝাপসা, ধূ-ধূ করছে সর্বগ্রাসী বুনো বালির চর, যতদিন নদী বইছে ততোদিন চড়া এমনই স্থির অথচ অধরা। এমন সময় সোহম বললো দেখ আমার ভালো ঠেকছে না দূরে সাদা শেয়ালের থেকে বড় বাছুরের মত কি একটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আমিও খুঁজে পেতে মনে হলো যেন দেখতে পেলাম। একটা সাদা বাছুর, ঘোড়ার মত স্পিডে দৌড়চ্ছে, থামছে, আর চাঁদের হালকা আলোয় তার সাদা গা-টা চক্ চক্ করছে।
আমি খুব একটা কিছু বুঝতে পারলাম না, মৌসুমি-শুভদা তো দেখতেই পেলো না। গজর গজর করতে করতে আমরা এরপর আরও খানিকটা এগিয়েছি, বাংলো তখনও বহু দূর, দেখি এক-বিন্দু আলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, আমরা যতই এগই, সেও সরে সরে আসে, কেমন অদ্ভুত চাল--দুলকি চলে গোছের, কেমন মিন মিনে চলন, বালির চরে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে, আর ক্রমে আরও এগিয়ে আসছে, আমরা একটু অস্বাস্তিতে পড়েছি, কিন্তু এগচ্ছি, দেখি আলোর বিন্দুটা একটা ছায়া মূর্তির মত লাগছে--সরে সরে যাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। আমরা জোরে হাঁটছি কিন্তু সেও আর পিছু ছাড়ে না। রাত তিনটের সময় এরকম অবস্থা, শুভদা ঘামতে শুরু করেছে, সহম দাঁড়িয়ে গেছে ভয়ে, মৌসুমি দাঁড়িয়ে 'ওরে কি আসছে রে' বলে যাচ্ছে, আমার ভেতরেও শীতল স্রোত। এদিকে আমরা দাঁড়ালেও সে আমাদের পেছন ছাড়ে না, এগিয়েই আসে এগিয়েই আসে, ভয়ে আমরা আর তাকাতেও পারছি না ওদিকে। এমন সময় সোহম বলে কি না আরে ভাবী জি তো!
ভাবী জি মানে দারোয়ান জির স্ত্রী, পাশের গ্রামের মেয়ে, বাংলোয় গেস্ট এলে বাংলোয় এসে থাকে, রান্না করে, গ্রামের মহিলা সমিতির সদস্য, একটি বাচ্চা ছেলে আছে। আমরা চরের মধ্যে দিক খুঁজে পাবো না বলে, সে আন্দাজে ভর করে, একটা কুপি হাতে আমাদের বাংলোয় নিয়ে যাবে বলে এসেছে। এদিকে এসব কি আর আমরা জানি, আমাদের তখন যা তা অবস্থা ... ভাবী জি কে আবিস্কার ক'রে ধড়ে প্রাণ পাওয়ার জোগাড়।
তারপর হেসেই খুন, ফিরতে ফিরতে রাস্তায় শুরু হলো তরজা, কে ভয় পায়নি তাই নিয়ে। বাংলোর আলোর দেখা মিললো; সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম ক্রান্তি, আমাদের আল্লাদি কুতুয়া, ঘর থেকে কান্নাকাটি করছে, ওকে একা রেখে যাওয়া হয়েছিলো।


