SIMULCRA AND SIMULATION
শিশু পাঠ্য সাহিত্য, কিশোর সাহিত্য, এবং পরিনত সাহিত্য, সত্যি কি এদের মধ্যে কোনো সীমারেখা বর্তমান?
একটি শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে সম্পূর্ণভাবে তার বাবা মায়ের ওপর নির্ভরশীল। এটি একটি আত্মকেন্দ্রিক অবস্থান। কালের নিয়মে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, delayed gratification-এর মধ্যেদিয়ে, এই নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কাটে, মানুষের মনের উদারতা বাড়ে, মানুষ পরিনত হয়। দেখাযায়, মানুষ অপরের ওপর নির্ভরশীল না হলে, নিজের সুবিধা অসুবিধার বাইরে অন্যের কাজকর্ম মননশীলতা এবং সিদ্ধান্তগুলোকে নিজের মধ্যে সহজে গ্রহন করতে পারে। যাইহোক শিশু যখন নির্ভরশীল তখন তার সুবিধাগুলো হারানোর আশঙ্কাও বেশি, সেখানে যদি জনৈক শিশু সাহিত্যে বলাহয় যে রাজা দুয়োরানীকে ছেড়ে সুয়োরানীর সঙ্গে সুখে ঘর করতে লাগলেন তখন শিশুর মনে তার বাবার দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা জন্মাতে বাধ্য, বিশেষত সে যদি নিজেকে দুয়রানীর পুত্র বা কন্যা মনেকরে থাকে! শিশু বয়সে অপরিনত পাঠক দ্বায়িত্ব ও ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। শিশু মনের অবস্থানে পাঠক মনে করতেই পারে যে রাজা শিশুকে ত্যাগ করলে শিশুর প্রতি ভালবাসার দ্বায়িত্ব কেন পালন করবেন তিনি, বা সুয়োরানীর সঙ্গে যদি রাজা ভালো থাকেন তাহলে অন্য রানির ছেলেমেয়েকে রাজা ভালবাসবেন কেন! শিশু মনে রাজার এই পরিত্যাগ, শত্রুতা বৈরিতা প্রতারণার সমান। এক্ষেত্রে কেউ কেউ বলবেন দুয়োরানীকে পরিত্যাগ করার রাস্তাটা তাহলে সহজ করে দিলে হয় না? যদি বলাহয় যে রাজাকে ছেড়ে দুয়োরানী মনের সুখে দিন কাটাতে লাগলেন? এক্ষেত্রে অন্য সমস্যা, শিশু-পাঠক তার মায়ের ওপর রাগ করে বসতে পারে। ভাবতে পারে তার মা স্বার্থপর—এই পঠন পাঠনের ফল বাস্তব জীবনে সুদূরপ্রসারী। তারমানে কি এই যে শিশু সাহিত্যে আমরা জীবনের কঠিন সত্যগুলো এড়িয়ে চলবো? লেখক লীলা মজুমদারের মতে, যা আসলে বেশ খানিকটা সমর্থনযোগ্য, আমরা কঠিন সত্য উদযাপন করবো ঠিকই কিন্তু তা এমন করে করতে হবে যা শিশুর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা তৈরি করবে না। তার নির্ভরশীলতা, আত্মকেন্দ্রিকতাকে এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেবে না। ঠিক এই যুক্তিতেই, তিন বাচ্চার মা, মানুষখেকো বাঘিনীকে গল্পে শিকার করার ঘটনা লেখা হলে তা শিশুপাঠ্য নাও হতে পারে, যেমন জিম করবেটের লেখা শিশু পাঠ্য নয়, বরং কিশোর সাহিত্য, কারণ তখন কিশোর পাঠক বাঘের বাচ্চার প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করলেও, সে গ্রামের লোকের দৃষ্টিভঙ্গি নিজের মধ্যে আপ্যায়ন করতে খানিকটা প্রস্তুত, কারণ সে ততো দিনে বেশ খানিকটা আত্মনির্ভর।
এছাড়া ইদানিংকালে অন্য একটা অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে বয়স্ক পাঠকরা শিশু সাহিত্য, বা কিশোর সাহিত্য অতিক্রম করে পঠন পাঠনের পরিধি বাড়াতে অনুৎসাহী। পরিনত জগতের জটিলতাকে এড়িয়ে গিয়ে তাঁরা যেন নিশ্চিত আশ্রয় খুঁজছেন কিশোর সাহিত্যে। বড়রা যেকোনো অবদমিত জটিল কারণে যদি কিশোর সাহিত্য সেলিব্রেট করেন, বা শিশু সাহিত্য সেলিব্রেট করেন, তার মানে এই নয় যে শিশু সাহিত্য আর পরিনত সাহিত্যের মধ্যে পার্থক্য নেই। প্রসঙ্গত সুকুমার রায়ের বেশিরভাগ লেখা শিশু সাহিত্য সম্ভবত নয়, কারণ শিশু মনে তা মজাদার হলেও গ্রহণযোগ্য বাস্তব—শিশু-পাঠক পরা-বাস্তব, চমৎকার-অতিবাস্তব, আর জাগতিক-বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে বিশেষ পারদর্শী নয়। তার কাছে সুকুমার রায়ের জগৎ বেশ অনেকটাই দিনে দুপুরে সম্ভব। অন্যদিকে একজন পরিনত বয়স্ক পাঠক যখন এগুলি পড়েন তখন এই ধারার সাহিত্যে অবাস্তব বিচরনে তাঁর মনে যে অপার বিস্ময় আর নস্টালজিয়া তৈরি হয়, সেই অনন্দ একটি খুদে পাঠকের কাছে অনধিগম্য। ফলে সুকুমার রায়ের মতো অনেকের রচনা পড়ে একজন পরিনত পাঠক যা পান তা কখনোই সিশুপাঠের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
না, শিশু সাহিত্য, কিশোর সাহিত্য, পরিনত সাহিত্য এক নয়। শিশু সাহিত্য রচনা যথেষ্ট কঠিন, বিশেষত সেই হযবরল যদি পরিনত পাঠকদের বিনোদন করতেও সক্ষম হয়।