সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
এখন ক্লাস ফোর | গ্রামের প্রান্তিক এক প্রাথমিক ইস্কুলের ছাত্র | দুপুরে পেটভরে মিড্ ডে মিল খায় বুড়ো | বুড়ো নামেই সবাই ডাকে এই কচি ছেলেটাকে | সে খুব আনন্দে থাকে সারাদিন | মা হোটেলে কাজ করে, বাবা ইঁটভাটার শ্রমিক | অভাব আছে, বুড়ো সব বোঝে। রাত্রে কোনোদিন মুড়ি গুড়, কোনোদিন একটা রুটি | কোনো অভিযোগ নেই তার মা বাবার প্রতি | জুতোটা ছিঁড়ে গেলেও ভ্রুক্ষেপ নেই | একটা সেফটিপিনই যথেষ্ট | কিন্তু গতবছরের শীত থেকেই একটা জিনিসের প্রতি তার একটা মোহ জন্মেছে ...
এবছরেও শীত এসেছে | স্থানীয় হাটের গোবিন্দ মন্ডলের কাপড়ের দোকানে ঝুলছে রকমারি শীতবস্ত্র | হরেক রকম সোয়েটার, টুপি, চাদর | ওর মধ্যেই একটা লাল টুকটুকে সোয়েটার তার খুব পছন্দ | এবছরেও দোকানে আলমারিতে ঝুলছে ওই লাল সোয়েটার |
বাবা মাকে কোনদিন বলেনি কিনে দেওয়ার কথা | বুড়ো জানে বাবার একটাই চাদর, মায়ের আবার তাও নেই | গেল শীতে মায়ের একমাত্র চাদরখানা ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়েগেছে | এই বয়সেও বড্ড পরিণত সে | কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশু মন তাকে রোজ বিকেলবেলা টেনে নিয়ে যায় ওই দোকানে, একটু দূর থেকে চোখ মেলে সে সোয়েটারটাকে দেখে| সন্ধ্যার চাঁদের আলো এসে পড়ে লাল সোয়েটারে | কখনো দোকানের ঝিলিমিলি আলোয় অপরূপ সুন্দর দেখায় বুড়োর প্রিয় লাল সোয়েটার |
বুড়োর আপাতত কোনো গরম জামা নেই | একটা টুপি আছে | খুব ঠান্ডায় দু-তিনটে জামা একসাথে পরে চালিয়ে দেয় | বুড়ো রাতের পর রাত স্বপ্ন দেখে এই সোয়েটার পরে, মায়ের হাত ধরে, সে বেড়াতে বেরিয়েছে | যাইহোক, সেদিন বিকেলে ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে | বুড়ো স্কুল থেকে এসেই দু তিনটে জামা গায়ে চাপিয়ে এক ছুটে হাটে | সেদিন গোধূলির ম্লান আলোয় তাদেরই পাড়ার মিত্তির মশাই দরদাম করে সেটি তার নাতিকে কিনে দিচ্ছিলেন | টপ টপ করে শিশির ঝরে পড়ছিল ওই সোয়েটারের লাল উলের ওপর | পিচ রাস্তার উল্টো দিক থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বুড়ো ... খুব কষ্ট পেয়েছিল সেদিন | প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এসেছিল সে |
বুড়োর মায়ের কদিন রাত্রে ফিরতে খুব দেরি হচ্ছে | হোটেলে নাকি খুব কাজের চাপ | সেদিনও দেরি হচ্ছিলো | মা বাড়ি এসে খুব ডাকছে "বুড়ো বাবা কোথায় গেলি? এদিকে আয়! দেখ তোর জন্য কি এনেছি !" বুড়ো হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো মায়ের ডাক শুনে | "এই দ্যাখ, নতুন সোয়েটার, বড্ড শীত পড়েছে, এটা তুই পরবি বাবা" ...অবিকল সেই লাল সোয়েটার! কিন্তু সে তো কখনো তার মাকে লাল সোয়েটারের কথা বলেনি ! আনন্দে খুশিতে বুড়ো কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে বললো--
"মা, এটার তো অনেক দাম ! এটা আমার ?"
"কদিন বেশি বেশি কাজ করে দিয়েছি, তাই মালিক খুশি হয়ে কটা টাকা বকশিশ দিল ! আমার পাকা বুড়োটাকে তো কোনদিন কিছু দিতে পারিনি, তাই এই সোয়েটারটা কিনেই নিলুম ! জিয়াগঞ্জের হাটে গিয়ে আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি, ওখানে দু পয়সা কমেও পেলুম। দেখিস তোর বাবা দেখলে খুব খুশি হবে |"
"আমার খুউব পছন্দ হয়েছে মা |"
বুড়ো এখন অনেকটা বড়ো | হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের চাপে বাবা-মা দুজনই আজ আর পৃথিবীতে নেই ! সে এখন একটা চায়ের দোকান করেছে | একাই থাকে..তবে কাঠের বাক্সের নিচের দিকে এখনো রাখা আছে ছোট্ট বুড়োর ওই লাল সোয়েটার ... ওটা ওর শক্তি|


