প্রায় অর্ধশতাব্দীর কাছাকাছি হল মনস্তত্ত্বের বিছোনো পথে আমার ঘোরাফেরা। স্কুল জীবনের সময় থেকে আজ … অনেকটা পথ, অনেক পড়া, অনেক দেখা, অনেককে চেনা … বোধ, অনুভূতির, যুক্তির মোড়কে মনের কতো ওঠা-নামা, কত ব্যক্তিত্বের খাঁজে খাঁজে মানসিক সম্পদের আস্বাদন। বই পড়ে মনের কথা কিছু বোঝা, গবেষণার আঙ্গিকে সূত্র ধরে মনকে জানা, অধ্যাপনার ছত্রে ছত্রে মন-বোঝানো, মন-পড়া, মনোবিশ্লেষনের জ্ঞানার্জনে সূক্ষ্ম মনের হদিশ পাওয়া, অসংযত, এলোমেলো মনকে বুঝে নির্দিষ্ট মানুষটিকে বোঝানোর জন্য, সামঞ্জস্যপূর্ণ মানসিকতার আদলে তাকে আনার জন্য সহমর্মিতা, নৈর্ব্যক্তিকতা, ছাপ-না-দেওয়া মানুষটিকে তার মত করে গ্রহণ করা, তার মনের দরজায় পৌঁছানোর জন্য বিশেষভাবে কথা বলা শেখা—সব নিয়েই মন-আবিরের দোল-খেলা। মনস্তত্ত্ব তাই আমার পেশা, আমার নেশা, আমার ভাষা, আমার দেখার আদল, আমার হৃদয়। ভালবাসি মনস্তত্ত্বের তাত্ত্বিক আলোচনা, ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে মন চেনানো—মন বোঝানো, ওপর-মনের চুলচেরা বিশ্লেষণে গভীর মনের ইতি সুর আনন্দময়তার হদিশ খোঁজা। অধ্যাপনায় বই পড়ানোর সাথে সাথে সমানতালে মনোবিশ্লেষণের অভ্যাস আমায় মানুষ বুঝতে শিখিয়েছে, উজাড় করে মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে, আপাত ভিন্ন স্বভাবের মানুষকে মন থেকে গ্রহণ করতে এগিয়ে দিয়েছে, দিয়েছে আত্মবিশ্লেষণে নিজের ত্রুটি চিনতে, জানতে ও তা পরিবর্তন করার চেষ্টায় ব্রতী হতে। মনস্তত্ত্ব তাই আমার কাছে মনের আলো, পৃথিবী-প্রকৃতি-মানুষকে চেনার একটা দৃষ্টিভঙ্গি।
মনস্তত্ত্বের আঙ্গিকে কাজ করতে গিয়ে অনেক জায়গায় বাংলায় আলোচনা করেছি, বাংলায় কিছু লিখেছি, বাংলাতে কিছু ভেবেছি। অসংলগ্ন সে সব কথা গুছোনোর কথা কখনো ভাবিনি। আজ অনেক ছাত্র-ছাত্রী ও বিদগ্ধ মানুষের অনুরোধে সেই ভাবনাগুলোকে, লেখাগুলোকে একত্রিত করার একটা প্রয়াস নিয়েছি। সংলগ্ন-সুরের অভাব থাকবেই তাতে—তবু বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলা এই কথাগুলো বা কিছু লেখা, সবই মনস্তত্ত্বের বিষয়কেন্দ্রিক। শুরু তাই মানসিক স্বাস্থ্যের বিশ্বের দরবারে অস্তিত্ব খোঁজা থেকে, সমাজের উন্নতিকল্পে তাকে কী করে ব্যবহার করা যায়, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় থেকে মন নিয়ে, মনের রাগের কথা, হিংসের কথা, সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা, নিঃসঙ্গতা, নারী-মননের ওঠা-নামা, পড়ন্ত মনের অবসন্নতা, হাসির মন, নৈঃশব্দে স্থিত-মন, মননে ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা, মুখই মনের আয়নাতে আসা, মাঝে অস্তিত্বের শুরু থেকে বিকাশের সাথে ‘মাকে’ আমার পৃথিবী ভাবা, সময়কে মন দিয়ে চেনা।আজ কোভিড আক্রান্ত পৃথিবী। অসুস্থতার প্রাবল্যে অনিশ্চিত জীবন, সব অঙ্ক হারিয়ে অসহায়ত্বে হাঁপিয়ে ওঠা মন, ঘরবন্দি জীবনের অস্বাচ্ছন্দ্য অবস্থান, অর্থ-উপার্জনে টান-পড়া কঠিন বাস্তব, ওষুধ-হাসপাতাল-একাকিত্বের ছবিতে ভেঙে পড়া মন, মৃত্যু মিছিলের ছবি দেখা আতঙ্কিত সত্তা—মনস্তত্ত্বকে গভীর জীবন-দর্শনে ঢোকায় প্রবৃত্ত করছে। কোভিড শেখাচ্ছে বস্তুতন্ত্রের জৌলস, আকাঙ্ক্ষা, স্বস্তি-সুখ সবই অস্থায়ী, প্রাণশক্তির দিকে মন ফিরিয়ে ব্যক্তিত্বের অন্তরতম শেষে জীবনকে উপলব্ধি করার প্রয়োজন। প্রয়োজন শান্ত হওয়ার, স্থিত হওয়ার, নমনীয় হওয়ার—যুদ্ধ নয়, হিংসা নয়, অন্তর্দ্বন্দ্ব নয়, নয় সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অসহযোগিতা। তাই এই পরিপ্রেক্ষিতে মনের ওঠা-নামায় আরও কয়েকটি রচনা—করোনার প্রকোপ, আধ্যাত্মিকতার প্রথম পাঠ, এখনই, ভালো থাকা ও আমি তখন আকাশ। মনন শুধু বহির্বিশ্বকে চেনার জন্যে নয়, অন্তর্মুখী মন জীবনশৈলীর অনেক গুণ আহরণ করায়, জীবনকে চেনায়, অযথা উদ্বেগের হাত থেকে মুক্ত করে—ছড়ানো প্রকৃতির গভীর আবেশ নিজস্ব মননের অনুরণনে নিজেকে শান্ত, স্থিত করে। অপরিণত মননের দুরন্তপনার একমাত্র অবসান সম্ভব পরিণত মননের প্রকৃতির সাথে, প্রাণশক্তির সাথে একাত্মতার মেলবন্ধনে।ছোটো ছোটো লেখা … মন চেনানোর বর্ণপরিচয়। পড়ে দেখলে, গ্রহণ করলে—সত্যি খুশি হব।
—নীলাঞ্জনা সান্যাল
মনস্তত্ত্ব ও আজকের জীবন
Please select a suitable option while checking out.
General post is free.
Trackable post is chargable.
Fulfilled by IndiaPost