শুরুর কথা,
শিশু-কিশোরের মন-মানসিকতার কিছু টুকরো ছবি নিয়ে বেশ কয়েকটা লেখার সংকলন এই বইটি। মনস্তত্ত্বের অধ্যাপনায়, মনোবিশ্লেষণের আঙ্গিকে পাওয়া মা-বাবা ও ছোটোদের, সমাজের প্রতিচ্ছবিতে ওদের মনের আকার-বিকার বোঝানোর দায়িত্বে, খুব গভীরভাবে ওদের মন-পড়তে চেষ্টা করেছি। যখন যেটুকু মনে এসেছে, কাগজের পাতায় তার আঁকিবুকি কেটেছি। আজ পড়ন্ত বেলার জীবনে অবকাশের অভাব থাকলেও মন বলছে লেখাগুলো একত্রিত করে সবার সামনে তুলে ধরি। অনেক সময় ধরে যত্ন করতে পারলাম না, তবু এলোমেলো করেই ওদের মনের কথা, মনের খোরাক, মন-হারানোর ব্যথা আমার ভাষায় তুলে ধরলাম। শিশু-কিশোর মন অপরিণত মনন। বড়ো হওয়ার পথে এগোনো, শরীর-ঝুঁকে থাকা মন পৃথিবীকে যে রঙে দেখে, যে দৃষ্টিকোণ দিয়ে চিনতে চেষ্টা করে, বড়োদের থেকে তা অনেক আলাদা। ওদের যত্ন করে বড়ো করতে পারলে সংসারের লাভ, সমাজের উন্নতি, দেশের-দশের যশ, নিজেদের জীবন-খাতায় অর্থপূর্ণ কিছু লেখার বিষয় সৃষ্টি। যত্ন করা মানে আগলে রাখা নয়, যত্নের কাঠিন্যে শাসনের বেড়াজালে বেঁধে ফেলা নয়, একমাত্র সন্তান মনে করে ইচ্ছেপূরণের অবারিত দ্বার খুলে দেওয়া নয়, নিজেদের ইচ্ছের বোঝা ওদের চাপিয়ে দিয়ে শ্বাসরোধ করা নয়। জীবন মানে সুখ, জীবনেই দুঃখ, জীবন মানে কষ্ট নেওয়া, জীবনেই অনেক পাওয়া। জীবন মানে আমি-বোধ—তুমিকে চিনতে শেখা, মানিয়ে নেওয়া। পৃথিবীর সৌন্দর্য-রুক্ষতার হিসেব-নিকেশ ওদের বোঝার মতো করে বুঝিয়ে দেওয়া বড়োদের কর্তব্য। জীবন মানে শুধু ক্লেশ নয়, শুধু দুঃখ পাওয়া নয়—জীবনকে বুঝতে পারলে অনেক আনন্দ, অনেক তৃপ্তি—দুঃখের উপস্থিতি নিশ্চিত হলেও তার তীব্রতার রাশ। ছোটোদের বোঝানোর আগে বোঝা দরকার, ওদের কথা, ওদের ব্যথা চেনা দরকার। কোনদিকে আজ যাচ্ছে সমাজ, কী করছে ওরা? ওরা কি ভালো আছে না হিংসে, রাগ, বিষাদে, জীবনকে অন্ধকারময় দেখছে? ওদের সহজাত সরল মনে সব কিছু সাদা। অভিজ্ঞতার তারতম্যে সে মন হয় রঙিন নয় কালো হয়ে যাচ্ছে। সূত্র ধরে পৌঁছোনো দরকার ওদের কাছে। তাই বড়োদের আচরণ মনে রেখেও ওদের জন্যে কিছু ভাবনা তুলে ধরলাম সবার কাছে। বড়োদের মনের একচিলতে পরিবর্তনও সম্ভব হলে আমার চেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখবে। নিজস্ব জীবনের অগুনতি অভিজ্ঞতা, অজস্র ব্যক্তিত্বের সমাগম, অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছোটোদের উপস্থিতি, মানসিক বৈকল্যে হারিয়ে ফেলা মনের ছবি নিয়ে শ্রান্ত-অবসন্ন আরও কিছু ছোটোদের কথা শোনা, জীবন-জানা আমায় প্রবৃত্ত করেছে এ লেখাগুলো লিখতে। আমি সবার কাছে, জীবনের সবরকম অভিজ্ঞতার পরিসরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার চেতনার স্বচ্ছতা আনার জন্য। অজস্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশকের জন্যে—যার সাহায্য এ বইয়ের জন্মদাতা।
নীলাঞ্জনা সান্যাল
শিশু কিশোর মন, হদিশের নানা সূত্র
Bengali