top of page
Search

হালকা গদ্যের আয়নায় খণ্ডিত যাপনচিত্র

জীবনের শেষবেলায় আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি’ শিরোনামে পাক্ষিক কলাম লিখতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই হালকা চালের কাগুজে রচনাগুলিকেই একত্রিত করে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছে এই বইটি। হালকা চালে লেখা নিবন্ধগুলির প্রায় প্রত‍্যেকটিতে রয়েছে লেখকের নিজস্ব জীবনবোধের ছোঁয়া যা সধারণ পাঠকের আবেগতাড়িত মনে নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, যদিও সেই জীবনবোধে মিশে রয়েছে বেশ কিছু অসঙ্গতি ও অগভীর দৃষ্টিকোণের বাহুল্য। কলামটি ২০১০ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১২-র অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় দু’বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। দু’বছরে প্রকাশিত মোট পঞ্চাশটি নিবন্ধ বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরপুর। প্রবীণ সাহিত‍্যিকের আজীবন অভিজ্ঞতায় জারিত দেখা-শোনার ফসল হিসেবে জন্ম নেওয়া রচনাগুলির মধ্যে পারিপার্শ্বিক নানান ঘটনা ও দৃশ‍্যাবলী চমৎকার ফুটে উঠেছে। সমাজের নানা স্তরের রঙবেরঙের মানবচরিত্রের মিছিল সারিবদ্ধভাবে হেঁটে গেছে সুনীল-লেখনীর মায়াস্পর্শ গায়ে মেখে। বেশিরভাগ লেখাতেই ভালোবাসার মেদুর আবেশ, সমালোচনা থাকলেও তা কখনোই কট্টর ও বঙ্কিম নয়—লেখকের পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে চাওয়ার দায় সেখানে প্রকট।

অনেকগুলি রচনায় সমকালীন নাট‍্যজগৎ নিয়ে তাঁর হালকা ও স্বাদু বিশ্লেষণ তিনি তুলে ধরেছেন। সেসব লেখায় নবীন নটের অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে অফুরান প্রশংসা যেমন বর্ষিত হয়েছে, তেমনই আক্ষেপ ঝরে পড়েছে কোনো কোনো নাটকের কৃত্রিমতায় আক্রান্ত হওয়ার দুর্দশা দেখে। তবে আশাবাদী সুনীল বাংলা নাটকের উত্তরণের কথাই লিখেছেন আর তাই ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’-ই মূলত স্থান পেয়েছে তাঁর রচনায়। যেটুকু বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে তা অতি সন্তর্পণে পরিবেশিত। একাধিক রচনায় লেখক গভীর দুঃখ ও অভিমান প্রকাশ করেছেন বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির, বিশেষত ভারতবর্ষের বাঙালির অবজ্ঞা ও অনাদর প্রত‍্যক্ষ করে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন‍্যতম জনপ্রিয় সাহিত‍্যিক তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আর্তি জানিয়েছেন যে প্রাণাধিক প্রিয় বাংলা ভাষাকে সসম্মানে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি ও তাঁর বন্ধুরা যেমন একসময়ে রাস্তায় নেমেছেন, তেমন নতুনরাও এগিয়ে এসে সেই গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিক। বাংলা ভাষার অবমাননা যে তাঁর কাছে কতটা পীড়াদায়ক তা বারবার আকুলভাবে ব‍্যক্ত করেছেন লেখক। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্রমাবনমন বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ এই লেখাগুলিতে নেই। আক্ষেপ থাকলেও তা অতিক্রম করার কোনো দিকনির্দেশের প্রচেষ্টাও নেই। তাই ভাষা নিয়ে কিঞ্চিৎ ভাসা-ভাসা আবেগের বাইরে গিয়ে কোথাও পৌঁছোতে পারেনি রচনাগুলি। চারপাশের নানান হিংসাত্মক ঘটনা তাঁর মর্মমূলে কী গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে তা যেমন নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন সুনীল, তেমনই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন: ‘...যখন কোনও সাংঘাতিক ঘৃণ্য ব‍্যাপার ঘটতে থাকে, যার প্রতিকার করার ক্ষমতা আমার নেই, শুধু শুধু মর্মযাতনা ভোগ করতে হয়, তখন আমি কোনও প্রিয় কবিতার বই খুলে পড়তে শুরু করি। প্রথম কয়েক মিনিট মন বসাতে পারি না, তারপর আস্তে আস্তে নিমজ্জিত হই কবিতার রসে। হ‍্যাঁ, কবিতার সেই শক্তি আছে। বাস্তবের নগ্ন দিকটা সে ভুলিয়ে দিতে পারে।’ কিন্তু ‘বাস্তবের নগ্ন দিকটা’ কাব্যরসে জারিত হয়ে ভুলে থাকা কোনো প্রথম সারিতে থাকা জনপ্রিয় সাহিত্যিককে আদৌ মানায় কি? এই প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমেই তিনি সংশ্লিষ্ট ‘ঘৃণ্য ব্যাপার’-এর প্রতিকার করার ‘ক্ষমতা’ তাঁর নেই মনে করে ‘কবিতার রসে’-র শরণাপন্ন হলে তো তা একপ্রকার পলায়নবৃত্তিকেই প্রতিফলিত করে। অবশ্যই সেটা সংশ্লিষ্ট সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর বিবেকের উপর নির্ভরশীল, তাঁর সে স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি পথে নেমে প্রতিবাদ করবেন, নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিবাদ করবেন, নাকি কবিতা পাঠে নিমজ্জিত থেকে মর্মবেদনা থেকে রেহাই পাওয়ার পথ খুঁজবেন—সেটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছের উপরেই নির্ভরশীল। অন্তত সুনীল এই বিষয়ে সৎভাবে ও স্পষ্টভাবে নিজের মনোভাব তুলে ধরেছেন। সেই মনোভাবের প্রতি সহমত পোষণ করতে অপারগ হলেও স্পষ্টবাদিতার জন্য সাধুবাদ দিতেই হয়। আজীবন ভালোবাসার কাঙাল সুনীল জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে মাঝেমাঝে যখন নতুন যুগের টেক-স‍্যাভি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গভীর মনন ও সহমর্মিতার অভাব অনুভব করেন, তখনও মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা কষ্টের মধ‍্যেও তিনি আশা ত‍্যাগ করেন না বলে জানিয়েছেন। আর তাই দিকশূন‍্যপুরে চলে যাওয়ার ক’দিন আগে শেষ কলামটিতে লিখে যান: ‘এখন ছেলেমেয়েদের মেলামেশার কত সুযোগ রয়েছে। ও-রকম লুকোচুরির কোনও দরকার নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তা এ-কালে বরবাদ হয়ে যায়নি নিশ্চয়ই।’ যেহেতু সংবাদপত্রের সবশ্রেণির পাঠকের জন্য নিবন্ধগুলি রচিত, তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয় ও ভাষায় তরলতা বড্ড বেশিরকমভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। জটিলতার জটাজাল লেখক বোধহয় সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। নিজের নাস্তিক মনোভাব সম্পর্কে দৃপ্ত ঘোষণার পাশাপাশি কিছু কিছু বিষয় আলতো করে ছুঁয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিত তৈরি হতে পারে উপলব্ধি করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন লেখক। আর সেই এড়িয়ে যাওয়ার কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েও দিয়েছেন পাঠকদের—অনেকটা রাহুল দ্রাবিড়ের ফরোয়ার্ড ডিফেন্সের ধাঁচে। তাই মননের মধুর সন্ধান হয়তো এই বইতে মিলবে না, তবে জল-বাতাসাটুকু জুটবে। আড়াইশো পৃষ্ঠার এই বইতে সংকলিত সহজ ভাষায় লেখা সরল নিবন্ধগুলি অনায়াসে পড়ে ফেলা যায় আর পরিচিত হওয়া যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষবেলার ভাবনা-চিন্তাগুলোর সঙ্গে। তিনি ‘একা একা কথা’ বলার ব‍্যাপারটি শিরোনামেই বলে দিয়েছেন। কাজেই পাঠক তাঁর সেই আপাত আত্মকথনের শরিক হতে চাইলে এই বইয়ের পাতা ওলটাতে পারেন। কেউ যদি এই বই পড়তে বসে গুরুগম্ভীর তত্ত্ব-তালাশে নিমগ্ন হতে চান কিংবা সহজ কথায় গভীর জীবনদর্শনের স্বাদ পেতে চান, তাহলে তিনি যে নিরাশ হবেন সেকথা বলাই বাহুল্য।


নাম: যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রচ্ছদ: সৌরীশ মিত্র মূল্য: ₹৪০০

 
 
 

コメント


©2021 by SPOUT BOOKS. Proudly created with Wix.com

bottom of page