ভিজে যাওয়ার গল্প
কাকভোরে বারান্দা থেকে রাস্তার বৃষ্টি দেখছি, ভাবছি এই অবিশ্রান্ত বর্ষায় আজ বাইরে বেরোনো অসম্ভব | ঠিক যেমন ভাবতাম বছর পঁয়ত্রিশ আগে―স্কুল ছুটির আশায়। গ্রিল থেকে বৃষ্টির ঝাপটা মুখে লাগতেই চোখের কোনে জড়িয়ে থাকা ভোর জানান দিলো “আসি, তাড়া আছে”। আজ তাহলে বরং ছোটবেলার সেই খিচুড়ি-ইলিশমাছ-বর্ষা, কাগজের-নৌকা-বর্ষা, কইমাছ-ধরা-বর্ষা … এসবের কথা থাক, কিন্তু … বহু বছর পর ছোটবেলার গন্ধ মাখা ভেজা মেঘের মতো জড়িয়ে ধরে বৃষ্টির এক-ফোঁটা, দু-ফোঁটা, তিন ফোঁটা … মেঘ-বারান্দায় ঠাণ্ডা জলের আস্তরণ পড়ে।
ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ গোপালের সঙ্গে ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি দেখেছি, কাদা মাঠে আছাড় খেয়ে চোট্ পেয়েছি, ব্যাগ মাথায় ধূসর মেঘেদের আনাগোনা দেখতে দেখতে ভিজে বাড়ি ফিরেছি। বৃষ্টি নিয়ে গোপালের বহু ভাট-বকা সহ্য করেছি, ওর অদ্ভুত খড়খড়ে ভাঙা গলার কবিতা শুনেছি। একসাথে ফাঁকি মেরেছি―ঠিক কাকে ফাঁকি মারতাম, আজও জানিনা … আজ সেই গোপাল মেঘবৈঠায় একবারে আমার বারান্দায়। বর্ষা-কানা আমার দু-চোখ দিয়ে গাল বেয়ে কুলকুলিয়ে বয়ে চলেছে কানা-নদী। এই নদী বইত গোপালের বাড়ির পিছন দিকে, এখনও বয় ... ঘোর বর্ষায় কানা-নদীর দু-কুল হয়তো আজও উপচে পড়ে, আর খোঁজ নেওয়া হয়নি তার।
ও হ্যাঁ … কাঁদতে কাঁদতে বলেই ফেলি একটা হাসির কথা, তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেন, ধর্মরাজবাবুর বাংলা ক্লাস। এমন সময় আমার তীব্র প্রকৃতির ডাক এসেছে। তখন আমাদের স্কুলে কাজ চালানোর মতো শৌচালয় ছিলো কিনা মনে নেই। বোধহয় ছিলো না। বাইরে সারাক্ষণ ঝিম-ঝিম করে টানা বৃষ্টি পড়ছে, দূর দুরান্ত পর্যন্ত ঘষা কাঁচের স্যাঁতস্যাতে আলোতে একটি লোকের অবয়বও চোখে পড়ছে না, এদিকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কাদামাখা রাস্তা দিয়ে আমি ছুটছি। বড় পুকুরের উঁচু জঙ্গলাকীর্ণ পাড় ছিলো একমাত্র মুক্ত-ক্ষেত্র, মুক্তিরও। বৃষ্টির বহরে ক্লাসের অন্য ছেলেরা কেউ সঙ্গে আসতে চায়নি। হঠাত দেখি গোপাল ছাতা নিয়ে আমার সঙ্গে, স্যার কে ম্যানেজ করে আমার বডিগার্ড হিসেবে এসেছে। কোনো রকমে কাজ সেরে পুকুরে হাত ধোয়ার জন্য যেই নেমেছি, সঙ্গে সঙ্গে পা পিছলে সোজা এক গলা জলে। সেই মুহূর্তে আকাশে জল, মাটিতে জল, বাতাসে জল, চোখে জল, নাকে জল, মনে হচ্ছিল আকাশ সেদিন কোনো অজানা হিসেব কষে তার বৃষ্টির ঘড়া সম্পূর্ণ উপুড় করে দিয়েছে, কেবল আমারই ওপর, আমার জীবনের তিনভাগ নয়, পুরো চার ভাগই জল হয়ে গিয়েছিলো। গোপাল ছিলো, তাই হাঁচড়ে-পাঁচরে হাতড়ে অনেক কষ্টে সে যাত্রা উদ্ধার পেয়েছিলাম … দ্বিতীয় জীবন, সেদিন বুঝিনি। গোপালের কি সেসব মনে আছে? কে জানে!
… আমি বললাম চল্ গোপাল আবার বৃষ্টিতে ভিজি একদিন। গোপাল কিযেন বললো, ঠিক শুনতে পেলাম না, অস্পষ্ট শুনলাম, বোধহয় বাবার কথা বললো … দুম করে একদল উড়ো মেঘ এসে ওকে ডেকে নিয়ে চলে গেল। আমি বললাম আবার আসিস, বাবার কথা শুনবো। বাবাও তেমনি, ওই ভিজে-দেশে পাড়ি দেওয়ার কি ছিল?
সৌরভ চট্টপাধ্যায়।


