top of page

SPOUT BOOKS First look

Public·1 member

জিম


ree

জিম করবেট ১৯৫২ সালে মহারানীর ট্রি টপস সফরের একটি গল্প লেখেন। তিনি গল্পটা লেখেন ১৯ এপ্রিল ১৯৫৫ সালে, কেনিয়ায়, মৃত্যুর কিছুদিন আগে। তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছর।


তিনি ১৯৫১ সালে যখন ইংল্যান্ডে যান, তখন তাঁর বয়স বিশেষ বোঝা যেত না। কিন্তু তিনি ভারতে একবার খুব অসুস্থ হয়েছিলেন, সেখান থেকে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেননি। সেই সময় তিনি জঙ্গলে ব্রিটিশ সেনাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন, যারা পরে বার্মার যুদ্ধে অংশ নেয়।


আমি ঠিক জানি না, পাঠকরা তাঁর সম্পর্কে কী ভাবেন, অথবা সেই অনুভব আদৌ তাঁর বন্ধুদের স্মৃতির সঙ্গে মিলবে কিনা, তবে একটা ব্যাপারে পাঠকেরা হয়তো একটু বেশি ভাগ্যবান তা হলো জিমের লেখা। জিম করবেট খুব কমই মানুষখেকো বাঘের সঙ্গে তার সাঙ্ঘাতিক সব অভিজ্ঞতার কথা বন্ধুদের বলতেন, যেগুলো এখন তার বইয়ে পড়ে আমরা অবাক হই, বিস্ময় বোধ করি। জিম মনে করতো, এসব অভিজ্ঞতা তাঁর নিজস্ব, খুব বেশি হলে তাঁর ও সেই বাঘ-চিতাদের মধ্যে সেসব সীমিত থাকা উচিত—এই বাঘ-চিতাদের শক্তি ও সাহসকে জিম শ্রদ্ধা করতো। এমনকি যারা মানুষের জন্য বিপদ হয়ে উঠেছিলো, সেসব মানুষখেকো জানোয়ারের ভুলগুলোও জিমের স্মৃতিকে এক রকম হার মানাতো।


আমরা অনেকে বুঝতেই পারিনি যে এই শান্ত ও সাধারণ মানুষটির নাম ও কাজ কুমায়নের পাহাড়ি গ্রামের মানুষদের কাছে কতটা পরিচিত। আমার মনে হয়, বই বিক্রির কিছু টাকা সেন্ট ডানস্ট্যান্স ফান্ডে যাওয়ার কোনো সম্ভবনা ছাড়া জিম হয়তো কখনওই তার প্রথম বই Man-eaters of Kumaon (১৯৪৪ সালে প্রকাশিত) প্রকাশ করতো না। এই সংস্থাটি এক বছর আগে, মানে ১৯৪৩ সালে দৃষ্টিহীন ভারতীয় সৈন্যদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিলো। আমার মনেহয় জিম নিজেও ভাবেনি যে এই বইটা থেকে বিশেষ আয় হবে। জিম বুঝতে পারেনি তার গল্পগুলো কতটা চিত্তাকর্ষক, তাছাড়া জিম যেভাবে গল্পগুলো লিখেছিলো সেই লেখনী পাঠকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করেছিলো। পরে পুরো বিশ্ব বুঝেছিলো—জিমের কলমের জোর—যদিও লেখা সম্পর্কে প্রথমদিকে জিম নিজেও খুব ওয়াকিবহাল ছিলো এমন নয়, সর্বপরি জিমের লেখা কোনো কৃত্রিম চেষ্টার উপর নির্ভর করতো না। গল্পগুলোর কেন্দ্রবিন্দু যেহেতু জিম নিজে, তাই এসব গল্পে জিম করবেটের ব্যাক্তিগত জীবন ও অভ্যাস সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যায়।


যাঁরা My India আর Jungle Lore পড়েছেন, তাঁদের আলাদা করে বলার দরকার নেই যে জিম একটা বড় পরিবারের সদস্য ছিলো। গরমকালে তারা হিমালয়ের নাইনিতাল শহরে থাকতো, আর শীতকালে তাঁর পরিবার কালাডুংরি নামের একটা ছোট উপত্যকায় থাকতো, নাইনিতালের নীচেই ছিলো কালাডুংরি। জিম ছোটবেলা থেকেই শিকারপ্রেমী, শিকার-করা উপভোগ করতে হলে জঙ্গল আর বন্যপ্রাণীদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে—এই লক্ষ্য নিয়ে জিম গোড়া থেকেই জঙ্গলের সাথে ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। জঙ্গলে চুপচাপ চলাফেরা করার অভ্যাস, প্রকৃতির ধ্বনি ও দৃশ্য বোঝার ক্ষমতা এসবই তাঁর ছোটবেলায় রপ্ত করা। সে রাইফেল-চালনায় যে ক্ষিপ্রতা ও নৈপুণ্য অর্জন করে, সেটার ভিত্তিও তখনই তৈরি হয়। এসব নিয়ে জিম কখনোই গর্ব করতো না। তার কাছে সঠিকভাবে গুলি চালানো ছিল একটা দায়িত্ব, কোনো কৃতিত্ব নয়। যদি কোনো প্রাণী মারা হয়, তবে শিকারে সেই প্রাণী যেন কষ্ট না পায়, ব্যাপারটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা ভালো—এটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো। নাইনিতালে ইস্কুল-জীবন শেষ করার পর জিম রেলওয়েতে চাকরি পায়। শুরুতে ছোট ছোট পদে কাজ করেছিলো সে, পরে মোখামেঘাটে রেল পরিবহনের দায়িত্বে ছিলো জিম। তখন গঙ্গা নদীর ওপারে একটা বড় ফাঁকা জায়গা ছিলো, যে চড় দু’পাশে দুই রেলপথকে আলাদা করতো। আজ সেখানে একটা বড়ো সেতু আছে, কিন্তু তখন বছরে পাঁচ লক্ষ টনেরও বেশি মালা নদী পার করিয়ে এক রেললাইন থেকে আরেকটিতে তোলা হতো। এই কাজ খুবই কষ্টকর, তবুও জিম ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কাজে তদারকি করেছে—শুধু তাঁর শারীরিক সহ্যশক্তি নয়, ভারতীয় শ্রমিকদের সাথে ভালো সম্পর্কের জন্যও এই দায়িত্বে জিম এতদিন টিকতে পেরেছিলো। জিম করবেট একজন ঠিকাদার হিসেবে অনেক শ্রমিক নিয়োগ করেছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জিমের প্রতি এই শ্রমিকদের ভালবাসা জিমের জীবনের একটি অমুল্য উপহার। সে সময় সে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কুমায়ন লেবার কোর গঠন করে, এবং নিজেই সেই দলকে নিয়ে ফ্রান্সে যায়। তার অনুপস্থিতিতে মোখামেঘাটের ভারতীয় সহকর্মীরা ও শ্রমিকরা একসাথে ঠিক করে যে তার কাজ তারা চালিয়ে যাবে। যুদ্ধের সময় তাকে ‘মেজর’ পদমর্যাদা দেওয়া হয়। ওই কয়েক বছর জিমের কাজ এত বেশি ছিলো যে শিকারে যাওয়ার বিশেষ সময় সে পায়নি। কিন্তু ছুটিতে কুমায়নে যাওয়ার সময়, তিনবার মানুষখেকো বাঘ-চিতার হাত থেকে স্থানীয় লোকজনকে রক্ষা করার জন্য সে তৎপর হয়। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে চম্পাওয়াত এবং মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো বাঘ, ও পনার চিতার হাত থেকে সে এলাকাগুলোকে মুক্ত করে। চম্পাওয়াত ও পনার-এর এই দুটি জন্তু মিলে প্রায় ৮৩৬ জন মানুষকে খেয়েছিলো—এরা ছিলো সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষখেকো, যদিও পরে আরও কুখ্যাত জন্তু দেখা গিয়েছিলো—যেমন রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘ, যে একাই সরকারিভাবে ১৫০ জন মানুষকে মারে। এটি বেশি পরিচিতি পায়, কারণ এই চিতা এমন একটা রাস্তায় মানুষ শিকার করতো যেখান দিয়ে বহু হিন্দু তীর্থযাত্রী তীর্থে যেতেন, জনপ্রিয় এক মন্দিরে।


মোকামাঘাটের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর, করবেটের জীবনে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়—জিম স্বাধীন হয়! তার চাহিদা ছিলো খুবই সাধারণ। সে অবিবাহিত ছিলো, কিন্তু নাইনিতাল ও কালাডুংরিতে তার দুই বোন থাকতেন, যাঁদের মধ্যে একজন (যাঁকে তিনি প্রায়ই “ম্যাগি” নামে উল্লেখ করেন) জিমের মৃত্যুর পরেও বেঁচে ছিলেন। যাইহোক, এই সময়েই মানুষখেকো বাঘ-চিতার সঙ্গে বেশিরভাগ সংঘর্ষ ঘটে, যেগুলো সে তার বইতে লিখে গেছে। বয়স বাড়লেও, জিমের শক্তি আর সাহসের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, রুদ্রপ্রয়াগের চিতার হত্যার সময় তার বয়স ছিল ৫১ বছর। এই অভিযানে সে প্রায়ই শিকারির বদলে শিকার হয়ে পড়েছে। ঠাক নামের এক গ্রামে, একটা মানুষখেকো বাঘকে মারার সময় তার বয়স ছিল ৬৩ বছর। শারীরিক কষ্ট বা বিপদের মুখোমুখি হয়ে করবেট কখনোই ক্লান্ত বা ভীত হয়নি।

 

তবে, এই সময় তার জীবনে আরেকটি পরিবর্তনও আসে। আগে শিকার ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য, কিন্তু এখন সেই আগ্রহ কমে যায়। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো, যতক্ষণ না বাঘ বা চিতা মানুষ মারছে, ততক্ষণ তাদের হত্যাকরা অনুচিত। অনেক সময় যখন আমরা একসাথে থাকতাম, পাহাড়ি মানুষের দল আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসতো। আসলে, তারা আমার কাছে নয়, শুধুমাত্র জিমের কাছেই আসতো। কারণ সবাই জানতো, জিম করবেট কুমায়ুন অঞ্চলের মানুষদের বাঁচানোর জন্য বহুবার নিজের জীবন বাজি রেখেছেন।

 

সাধারণ মানুষের জীবনের এই ভয় সাধারণ ভয় ছিলো না, বরং এটা এমন এক ভয়, যেখানে গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতো অপঘাতে মৃত্যু পাহাড়ের প্রাচীন দেবতাদের অভিশাপও হতে পারে। করবেট কিন্তু এসব ধ্যান ধারনায় বিশ্বাস করতো না। জিম নিজের শর্তে মানুষকে সাহায্য করতো, শুধু গরু বা ছাগল খেয়েছে বললেই সে শিকার করতে যেত না, সে নিজের বিবেকের কাছে পরিস্কার ছিলো। বাঘ জঙ্গলের রাজা, তার প্রাপ্যটা সে নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। যতক্ষণ না সে নিজে নিশ্চিত হতো যে, বাঘ ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ খাচ্ছে, মানুষ তার রোজকার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, ততক্ষণ সে হস্তক্ষেপ করতো না। এক সময় জঙ্গলের যে জীবন ছিলো শুধু শিকারের সহায়ক, যার জন্য জিম দিন রাত গভীর পর্যবেক্ষণ এবং মনন অভ্যাস করেছে, এখন তা ধীরে ধীরে তার অবসর বিনোদনের বিষয় হয়ে উঠলো। জিমের সঙ্গে পাহাড়ের ঢালে বা জঙ্গলের ভেতর দিন কাটানো খুবই উপভোগ্য ছিলো—জঙ্গলের প্রতিটি বাঁকা ডাল, প্রতিটি পাখি বা পশুর ডাক জিমের কাছে অর্থবহ; আর যদি সেই অর্থ সঙ্গে সঙ্গে বোঝা না যেত, তবুও সে তা নিয়ে ভাবতো, মজা করতো। তার কাছে এটা শুধু প্রকৃতির পাঠ নয়, এটাই ছিলো তার জগৎ—আর এই জগতে প্রকৃতির প্রত্যেক উপাদানের জীবনের বা মৃত্যুর সমান গুরুত্ব ছিলো জিমের কাছে। যদিও ততোদিনে শুটিংয়ের চেয়ে ফটোগ্রাফি তার কাছে তখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মনেপড়ে, আমি একবার বেসামাল এলোমেলো অবস্থায় জিমকে গভীর জঙ্গলের এক ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখি। সে পরে জানায়, ওখানে সে এক বাঘিনী আর তার বাচ্চাদের ছবিতুলতে চেষ্টা করে, আর বার বার বাঘিনী তাকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে তার মনেহয়, এক মানুষ মায়ের মতো এক বাঘ-মা-ও তার নিজস্ব জীবনে মানুষের এই অনধিকার হস্তক্ষেপ পছন্দ করছে না, এরপর জিম ব্যাপারটাকে আর বেশিদূর গড়াতে দেয়নি।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সে যখন সরকারের হয়ে সৈনিকদের জঙ্গল-যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলো, তখন তাকে সম্মানসূচক ‘লেফটেন্যান্ট-কর্নেল’ পদ দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালে তাকে ‘কম্প্যানিয়ন অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ (C.I.E.) খেতাবে ভূষিত করা হয়। এর আগেই সরকার তাকে এক বিশেষ অনুমতি দিয়েছিল, যা সে খুব গুরুত্ব সহকারে পালন করেছে—এটা ছিলো ‘জঙ্গলের স্বাধীনতা’; অর্থাৎ, দেশের সব সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জিম করবেটের প্রবেশের পূর্ণ অনুমতি।


কুমায়ুনের মানুষের জিম করবেটের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিলো তা আর আমি এখানে বিস্তারিতভাবে বলছি না। সাহসি, উদার জিম নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে সবার জন্য উজাড় করে দিয়েছে, বিনিময়ে কিছু চায়নি। আমার বিশ্বাস, জিম সেই অল্প কয়েকজন ইউরোপীয়দের মধ্যে পড়তে পারে, যাদের স্মৃতিকে ভারতীয়রা দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে, স্মরণ করে। এরপর ১৯৪৭শে যখন তার অনেক বন্ধু ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো, তখন করবেট এবং তার বোন ভারত ছেড়ে কেনিয়ার নায়েরি অঞ্চলে চলে আসে। আমি জানি জিম কালাডুংরিতে তার বাড়ি, তার গ্রামের লোকজনকে কত ভালবাসতো, তাঁরাও জিমকে নিজেদের লোক বলে মনে করতেন। কিন্তু নায়েরিতে ফটোগ্রাফির যে সম্ভবনা ছিলো, তা অতুলনীয়। জিমের সবচেয়ে প্রিয় পশু-পাখিদের অবাধ আনাগোনা ছিলো নায়েরিতে। নায়েরির সবুজের মধ্যে জিম ঘুরে বেরিয়েছে তার প্রিয় পশু পাখিদের এক ঝলক পাওয়ার আশায়। শুনে ভালো লাগছে যে নায়েরিতে রানী এলিজাবেথের (দ্বিতীয়) ভ্রমন অভিজ্ঞতা নিয়ে জিমের যে লেখা সেই লেখা নিয়ে বই বেরচ্ছে, এই নিয়ে বহুবার বহু বন্ধুকে জিম চিঠি লিখেছে। আমরা জানি এই অভিজ্ঞতা তাকে কতটা প্রভাবিত করেছিলো।


জিম করবেটের এই স্মৃতিচারণ করেছিলেন তাঁর বন্ধু হেলি (সম্ভবত গভর্নর উইলিয়াম ম্যালকম হেলি, লেখক নাম ব্যাবহার করেননি এখানে)।

এটি ১৯৫৫সালের OUP থেকে প্রকাশিত জিম করবেটের ট্রি টপস বইতে পাওয়াযায়।

স্বত্তঃ মূল লেখা ইংরিজিতে, মরাল রাইট হেলি (লেখকের), বর্তমান বাংলা-রুপান্তর করেছে স্পাউট বুকস। এইট্রান্সলেশনের অংশবিশেষ বা পুরো কাজ কথাও কপি করতে গেলে স্পাউটকে সেখানে লিখতভাবে ক্রেডিট দিতে হবে, এবং সেই কাজের সময় এই লেখায় যেকোনো পরিবর্তন হলে তারজন্য স্পাউট দায়ী নয়, তাও উল্লেখ করতে হবে।

ধন্যবাদ ।

 

 

 

 

5 Views

©2021 by SPOUT BOOKS. Proudly created with Wix.com

bottom of page